সম্পাদকীয়

মান উন্নয়নে গণমাধ্যমের ভূমিকা

গণমাধ্যমগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সংবাদপত্র, বেতার, চলচ্চিত্র, টেলিভিশন এবং ইন্টারনেট বা অনলাইন

সতীর্থ রহমান:

বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদে গুণগত মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে গণমাধ্যম নতুন যুগের সূচনা করতে পারে। সুশিক্ষাই জাতির মেরুদ-। শিক্ষাসমাজকে সভ্য করে, পরিবারকে করে শিষ্টাচার আর মানুষকে করে প্রজ্ঞাবান। যদি দেশের মানুষ অশিক্ষিত হয়, তবে পারিবারিক শিষ্টাচার ও ব্যক্তিগত প্রজ্ঞার কোনো মূল্য থাকে না। এ জন্য প্রয়োজন জনশিক্ষা বা প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষার আধুনিকায়নে গণমাধ্যম যুগান্তকারী অবদান রাখতে পারে। আমাদের দেশে গণমাধ্যমগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সংবাদপত্র, বেতার, চলচ্চিত্র, টেলিভিশন এবং ইন্টারনেট বা অনলাইন।

যারা অল্পশিক্ষিত সংবাদপত্র তাদের শিক্ষা ও জ্ঞানের পরিধিকে বৃদ্ধি করতে পারে। তবে সিনেমা বা চলচ্চিত্র থেকে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হতে পারে নিরক্ষররা। তারা তাদের পছন্দ অনুযায়ী ছবি দেখতে পারেন। রেডিওতে শ্রোতারা শুনে অনেক কিছু শিখতে পারে। তারা জানতে পারেন নতুন নতুন তথ্য ও সংবাদ। তবে টেলিভিশনে দর্শকরা শোনার সাথে সাথে দেখার সুযোগ পায়। সংবাদপত্র পড়ে, রেডিও শুনে, চলচ্চিত্রে ও টেলিভিশনে দেখে শুনে মানুষ অনেক কিছু জানতে ও বুঝতে পারে। সম্প্রতি ক্যাসেট, রেকর্ড প্লেয়ার, ডিস্ক, মেমোরি, প্রজেক্টরও শিক্ষা বিস্তারে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। ক্যাসেটে বা মেমোরিতে জমানো তথ্য প্রয়োজন অনুসারে সময় ও সুযোগ বুঝে কাজে লাগানো যায়। টিভি, রেডিও, চলচ্চিত্র শুধু বিনোদনের কাজে না লেগে যদি শিক্ষামূলক কাজে লাগে তবে মনের অনেক অন্ধকার এর মাধ্যমে দূর করা যায়।

সংবাদপত্র দৈনন্দিন জীবনের তৃতীয় নয়ন। এর মাধ্যমে আমাদের সামনে ভেসে ওঠে সমগ্র পৃথিবী। সংবাদপত্রের প্রধান কাজ সমাজ জীবনের নানা ত্রুটিবিচ্যুতি পর্যালোচনা করে পথনির্দেশ করা। এজন্য সংবাদপত্রকে ফোর্থ স্টেট বা চতুর্থ রাষ্ট্র বলা হয়। আসলে সংবাদপত্র হচ্ছে গণতন্ত্রের চোখ। এ চোখ দিয়েই সরকার সমাজের অনেক ভেতর পর্যন্ত দেখতে পায়। সংবাদপত্রের সাহায্যে চলমান পৃথিবীর বিচিত্র ঘটনার সাথে আমরা সহজে পরিচিত হতে পারি। রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, সাহিত্য ও যুদ্ধ বিগ্রহ সবকিছুই সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানতে পারি। বিদ্রোহ-বিপ্লব, প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং দেশের অজস্র চিত্র পাওয়া যায় সংবাদপত্রে। দেশে কোন মন্ত্রিসভা শপথ নিল, কে রাষ্ট্রপ্রধান হলো, কোন বিশিষ্ট লোক মারা গেল অথবা বিজ্ঞানের কী নতুন আবিষ্কার হলো, কে রাতারাতি বিখ্যাত হলেন, কে দুর্গমপথে পা বাড়াল, কোন পুরনো বন্ধুর সন্ধান পাওয়া গেলÑ এসব সংবাদপত্র আমাদের যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এ ছাড়া খেলাধুলা, আইন, আদালত, ব্যবসায়-বাণিজ্য, খুন-জখম, দুর্ঘটনা, চুরি-ডাকাতি, আমোদ-প্রমোদ, ধর্মকর্ম ইত্যাদি হাজারো সংবাদ থাকে সংবাদপত্রে। আজকাল শিক্ষকরা পেপার পত্রিকা খুব একটা পড়েন না। সংবাদপত্র ছাড়া জ্ঞান আসবে কোত্থেকে? সংবাদপত্রকে বলা হয় চলমান ইতিহাস। চলন্ত ইতিহাসের শিক্ষা নিয়ে আমাদের প্রস্তুত হতে হবে সুন্দর আগামীর জন্য। প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের সংবাদপত্র পড়ার যোগ্যতা অর্জন করাকে একটি প্রান্তিক যোগ্যতা হিসেবে সংযোজন করা উচিত।

রেডিওতে প্রচারিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিদ্যার্থীরা উপকৃত হয়। ছাত্রছাত্রীদের পঠন-পাঠনে সরাসরি কাজে লাগে এমন সব অনুষ্ঠান প্রায়ই রেডিওতে প্রচারিত হয়। তা ছাড়া নিরক্ষরদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারেও রেডিও বিশেষ সহায়ক হতে পারে। শিক্ষা বিস্তারে চলচ্চিত্রের ভূমিকা অত্যন্ত ব্যাপক ও দূরভিসারী। নিজের চোখে কোনোদিনই যে দৃশ্য দেখা সম্ভব হতো না, চলচ্চিত্র অবলীলাক্রমে তা দেখায়। নিজে কোনোদিন যেখানে হাজির হওয়া সম্ভব নয়, চলচ্চিত্র যেন নিমেষের জাদুমন্ত্রে সেখানে আমাদের পৌঁছে দেয়। এ ক্ষেত্রে আমরা চোখে দেখে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করি। এ অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ বলেই তার মূল্য বেশি। অল্প সময়ে অজস্র বৈচিত্র্যকে দেখার সুযোগ চলচ্চিত্র করে দেয়। মানুষ এর মাধ্যমে জীবন ও জগৎকে নবরূপে আবিষ্কার করতে পারে।

ভূগোল-ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, নৃ-তত্ত্ব ইত্যাদি আলাদাভাবে যা করে, অনেক সময় চলচ্চিত্রের সাহায্যে তা এককভাবে সাধিত হয়। প্রকৃতি ও জীবজগতের তথ্যচিত্রগুলো শিক্ষা ও জ্ঞানদানে আমাদের চিত্তকে করে পরিশীলিত। খেলাধুলা, উৎসব অনুষ্ঠানের প্রচারকে ঘিরে দেশে টেলিভিশনের জনপ্রিয়তা অনেক। জাতীয় জীবনের সংহতি, সমাজ জীবনের স্বাস্থ্য রক্ষায় এবং সর্বোপরি শিক্ষা বিস্তারে টেলিভিশনের ভূমিকা অপরিসীম। বিজ্ঞান শিক্ষা, সাহিত্যচর্চা, ধর্মীয় ও দার্শনিক মতবাদ প্রচার প্রভৃতি

নানা দিক দিয়ে টেলিভিশন জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

বিশ্বজুড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী বিপ্লব এনেছে ইন্টারনেট। ইন্টারনেটের কোনো সীমা নেই। অসংখ্য নেটওয়ার্কের সমন্বয়ে গঠিত বিশ্বব্যাপী বৃহৎ কম্পিউটার নেটওয়ার্ককে ইন্টারনেট বলে। ইন্টারনেট হলো নেটওয়ার্কের নেটওয়ার্ক বা নেটওয়ার্কের রাজা। পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় ইন্টারনেট চোখের পলকে কোনো তথ্য পাঠিয়ে দেয় বা এনে দেয়। ইন্টারনেটকেন্দ্রিক অনলাইন গণমাধ্যম এখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অনলাইন গণমাধ্যম অনেক সময় গুজব ছড়ায়। গুজবে কান দেবেন না। ফোন, ফেসবুক, ইন্টারনেট, প্রযুক্তির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বিকলাঙ্গ হয়ে যেতে পারে। প্রযুক্তির যুগে প্রযুক্তির ব্যবহার থেকে দূরে থাকার কোনো উপায় নেই। যোগাযোগের জন্য এর ব্যবহার করতেই হবে। কিন্তু কীভাবে এর সঠিক ও ফলপ্রসূ ব্যবহার করা যাবে এই শিক্ষা থাকা উচিত। সৃজনশীলতা থেকে উদ্ভাবনী চিন্তা আসে। আর তাই কম্পিউটারের সামনে বসে যন্ত্র হয়ে যাওয়ার কিছু নেই, সেটার নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার প্রয়োজন।

প্রাথমিক স্তরে গৎবাঁধা তাত্ত্বিক শিক্ষার বদলে জীবনঘনিষ্ঠ কর্মমুখী শিক্ষা চালু করা এখন যুগের দাবি। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য দরকার বৃত্তিমূলক শিক্ষায় শিক্ষিত লাখ লাখ কর্মঠ, উদ্যোগী যুবক। কৃষিতে, কুটির শিল্পে, বৃহৎশিল্পে, তথ্য-প্রযুক্তিতে সর্বত্র উৎপাদন ও সেবার মান বৃদ্ধি এবং উন্নয়নের জন্য চাই বৃত্তিমূলক শিক্ষা। আধুনিক বিশ্বে টিকতে হলে তত্ত্বীয় শিক্ষার সঙ্গে প্রায়োগিক, প্রাকটিক্যাল, ইন্টার্নশিপ যেমন : ফিল্ড ওয়ার্ক, প্রজেক্ট ওয়ার্ক, গার্ডেনিং, গ্রুপ ডিসকাশন, রিপোর্টিং, ডায়েরি লেখা, জেনারেল নলেজ ইত্যাদি বিষয়গুলো বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। হাইটেক বা অতিউন্নত প্রযুক্তির যুগে কোমলমতি শিশুদের কর্মমুখী ও জুতসই প্রযুক্তির শিক্ষা দেওয়া একান্ত প্রয়োজন। উন্নত দেশে শিক্ষা মানেই কাজ, চাকরি। তারা জীবন ও প্রয়োজন উপযোগী শিক্ষা লাভ করছে। তাদের পেশাভিত্তিক কারিগরি শিক্ষাই কাজের দিশা দেয়। প্রয়োগভিত্তিক শিক্ষা লাভের অভাবে আমাদের ছাত্ররা নিজের বা দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছেন, ‘জ্ঞানের চেয়ে বড় হচ্ছে কল্পনাশক্তি’। যার কল্পনাশক্তি নেই, তাদের এই পৃথিবীতে দেওয়ার কিছুই নেই। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা শিশুর কল্পনাশক্তিকে নষ্ট করে দিচ্ছে। শিশুরাই শক্তি, আনবে দেশের মুক্তি। শিশুর সুপ্ত প্রতিভা, সৃজনশীলতা, চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও কল্পনা শক্তিকে কাজে লাগাতে পারলে সুখীসমৃদ্ধ জ্ঞানভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন অনেকটা সফল হবে।

বিশ্বায়ন ও অবাধ তথ্যপ্রযুক্তির যুগে মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই গণমাধ্যমের কোনো না কোনো ভূমিকা রয়েছে। মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে প্রযুক্তি এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির বিভিন্ন বিকাশ মিডিয়ার মাধ্যম হয়েছে। জনগণকে সচেতন করার দায়িত্ব মিডিয়ার। জনগণের বাক-স্বাধীনতা বিকাশে মিডিয়ার ভূমিকা অপরিসীম। মিডিয়া সরকারসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সমালোচনা করে তাদের আরো সংশোধনের সুযোগ তৈরি করে দেয়। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব বিকাশে গণমাধ্যমকে আরো শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হবে। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে গণমাধ্যমই পারে নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে। রাষ্ট্রের সবগুলো প্রতিষ্ঠান ব্যর্থ বা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলেও মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে যে প্রদীপ শিখাটি জ্বলতে থাকে, তা হলো গণমাধ্যম।

উন্নত সমৃদ্ধ আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হলে প্রাথমিক শিক্ষাকে ঢেলে সাজাতে হবে। পুঁথিগত মুখস্থ বিদ্যার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে হাতে-কলমে দক্ষতা অর্জনের ওপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি জ্ঞান, শৃঙ্খলা ও ঐক্যের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে গভীর দেশপ্রেম, জনগণের প্রতি ভালোবাসা, কর্তব্য

নিষ্ঠা এবং অব্যাহত প্রচেষ্টার মাধ্যমে অগ্রসর হতে হবে। বিজ্ঞান শিক্ষার অগ্রগতির সাথে সাথে শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকা ক্রমেই বিশেষ অর্থবহ হয়ে উঠেছে। ভবিষ্যতে শিক্ষাকে সর্বজনীন ও সহজলভ্য করার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলো আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button