অপরাধ ও দুর্নীতি

‘গ্যাং কিলিং মাস্টার’ কে এই সুব্রত বাইন?

সুব্রত বাইনকে বলা হতো ঢাকাই আন্ডারওয়ার্ল্ডের ‘গ্যাং কিলিং মাস্টার’

তাজা খবর: প্রায় দুই যুগ আগে, ২০০১ সালের ২৫ ডিসেম্বর যে ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকার ঘোষণা করেছিলো, তাদের অন্যতম ছিলেন সুব্রত বাইন। তবে তারও আগ থেকেই রাজধানীর আন্ডারওয়ার্ল্ডে কুখ্যাত ছিলেন সুব্রত বাইন ও তার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সেভেন স্টার গ্রুপ।

খুন-চাঁদাবাজি থেকে এমন কোন অপরাধ নেই যেখানে সুব্রত বাইনের বিচরণ ছিলো না। বিশেষ করে কন্ট্রাক্ট কিলার হিসেবে তার খ্যাতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণে সুব্রত বাইনকে বলা হতো ঢাকাই আন্ডারওয়ার্ল্ডের ‘গ্যাং কিলিং মাস্টার’। শুধু রাজধানীতেই তার বিরুদ্ধে রয়েছে কমপক্ষে ৩০টি খুনের অভিযোগ

রাজধানী ছাপিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলাতে তার খুনের অভিযোগ আছে। ডাবল থেকে ট্রিপল মার্ডারের মতো অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তার নামে কোটি কোটি টাকার চাঁদা আদায়ের খবর আছে অজস্র। বলা হয়, সুব্রতের বেধে দেয়া চাঁদা নিয়ে বনিবনা করলেই বেঘোরে প্রাণ দিতে হতো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।

সুব্রত বাইনের অপরাধের গণ্ডি শুধু দেশের সীমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সীমানা পেরিয়ে ভিনদেশেও একদা তৎপর ছিলেন সুব্রত বাইন। মুম্বাই থেকে শুরু করে দুবাই আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতেন সুব্রত। শোনা যায়, কুখ্যাত মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গে একাধিকবার দেখা হয়েছে সুব্রত বাইনের।

কে এই সুব্রত বাইন? পুলিশের খাতায় তার পুরো নাম ত্রিমাতি সুব্রত বাইন। বহুদিন ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড কাঁপিয়ে ভারতের কারাগারে কিছু দিন বন্দি ছিলেন। সুব্রত বাইনের আদি নিবাস বরিশালের আগৈলঝাড়া থানার জোবারপাড় গ্রামে। তার বাবা বিপুল বাইন ছিলেন একটি এনজিওর গাড়িচালক।

মা কুমুলিনি আর তিন বোন মেরি, চেরি ও পরীকে নিয়ে ঢাকার মগবাজারের ভাড়া বাসায় থাকতেন। সুব্রত বাইন বড় সন্তান। ১৯৬৭ সালে তার জন্ম হয় হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। শিশুকাল কেটেছে বরিশাল জেলায়। সেখানে অক্সফোর্ড মিশন স্কুল নামে খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা করেন সুব্রত বাইন।

সেখানে হোস্টেলে থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন তিনি। সেখানে ভালো না করায় তাকে ঢাকায় শেরে বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে এসএসসি। এরপর সিদ্ধেশ্বরী কলেজে ভর্তি হতে গিয়ে সেখানকার এক নেতার সঙ্গে পরিচয়। কলেজে ভর্তি হওয়া আর হয়নি সুব্রতর।

তখন থেকে খাতা কলমের বদলে হাতে ওঠে অস্ত্র। ওই নেতার হাত ধরেই অপরাধ জগতে প্রবেশ ঘটে তার। ১৯৯১ সালে ঢাকার আগারগাঁও এলাকায় জাসদ ছাত্রলীগ নেতা মুরাদকে হত্যার মধ্য দিয়ে নামকরা সন্ত্রাসী হিসেবে সুব্রত বাইনের অভিষেক হয়। আন্ডারওয়ার্ল্ডে নিজের অবস্থান পোক্ত করতে শুরু করেন তিনি।

১৯৮৭ সাল থেকে মগবাজারকেন্দ্রিক আন্ডারওয়ার্ল্ডে বিচরণ করতে শুরু করেন সুব্রত বাইন। রফিক নামে একজনকে হত্যার মধ্য দিয়ে খুনাখুনিতে জড়ান সুব্রত। এরপর একে একে ট্রিপল, ডাবল মার্ডারের অভিযোগ পাওয়া যায় তার বিরুদ্ধে। শুরুতে অন্যের হয়ে কাজ করলেও, তার চোখ ছিলো নিজস্ব সাম্রাজ্য গড়ে তোলা।

সুব্রতর নেতৃত্বে মগবাজারে একটি সন্ত্রাসী চক্র গড়ে ওঠে। টোকাই সাগর, টিক্কা, সেলিম, চঞ্চল, মোল্লা মাসুদ ও তানভিরুল ইসলাম জয় মিলে গড়ে তোলেন সেভেন স্টার গ্রুপ। ওই গ্রুপে কাজ করার কারণে মোল্লা মাসুদের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সখ্য গড়ে ওঠে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের। মাসুদ হয়ে ওঠে তার ডান হাত।

১৯৯৩ সালের দিকে মধুবাজার বাজারে সবজি বিক্রেতা খুনে পুলিশের তালিকায় তার নাম ওঠে। কিছুদিন পর মগবাজারের বিশাল সেন্টার নির্মাণের সময় চাঁদাবাজি নিয়ে গোলাগুলি হয়। এর পর থেকেই সুব্রতর নাম গণমাধ্যমের শিরোনামে আসে। পরে বিশাল সেন্টারের দোকান মালিক সমিতির নেতা হন সুব্রত বাইন।

একটা সময় যুবলীগের লিয়াকত মগবাজার এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতেন। বলা হয় লিয়াকতের হাত ধরেই অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়ে সুব্রত। দিনে দিনে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর খুব কাছের লোক হয়ে যান সুব্রত। ওই সময়ে মগবাজার এলাকায় যে কোন অপরাধ কর্মকাণ্ডে নাম আসতে শুরু করে তার।

১৯৯৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ট্রিপল মার্ডারে নেতৃত্ব দেন সুব্রত। এ ছাড়া মগবাজারের রফিক, সিদ্ধেশ্বরীর খোকনসহ বেশ কয়েকজন তার হাতে খুন হন। এভাবে খুব অল্প সময়ে রাজধানীর দক্ষিণাংশের একটি বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ সুব্রত বাইনের হাতে চলে আসে।

সড়ক ও জনপথের কোটো কোটি টাকার টেন্ডার ভাগাভাগিতে সুব্রত বাইনের সেভেন সিস্টার্স সক্রিয়কে সব সময় সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে। সুব্রত বাইনের নামে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়ীদের হুমকি দিয়ে চাঁদাবাজি হয়েছে কোটি কোটি টাকা। কারাগার থাকলেও তার নামে চলতো চাঁদাবাজি।

তার বিরুদ্ধে সে সময় কমপক্ষে ৩০টি মামলা হয়। এর মধ্যে ১৯৯১ সালে আগারগাঁওয়ে মুরাদ খুনের ঘটনায় তার যাবজ্জীবন হয়। আইনশৃঙ্খলা সংশ্লিষ্টদের ভাষ্যে, আন্ডারওয়ার্ল্ডে সুব্রতের আবির্ভাবের পর গ্যাং কিলিং বেড়ে যায়। মূলত সুব্রত বাইনই আন্ডারওয়ার্ল্ডের ‘গ্যাং কিলিং’ প্রবণতা বাড়াতে ভূমিকা রাখেন।

১৯৯৭ সালে নয়াপল্টন এলাকার একটি হাসপাতাল থেকে গোয়েন্দা পুলিশের এসি আকরাম হোসেন গ্রেপ্তার করেন সুব্রত বাইনকে। বছর দেড়েক জেলে থাকার পর জামিনে বেরিয়ে যান। এরপর যেন তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন। রাজধানীতে চাঞ্চল্যকর সব খুনের ঘটনায় তার নাম আসতে শুরু করে।

মুরগি মিলন নামে এক সন্ত্রাসী খুন হওয়ার পর এই অভিযোগ মাথায় নিয়ে সুব্রত বাইন দেশ ছেড়ে পালান। আত্মগোপন করেন কলকাতায় আত্মগোপন। সেখানেও কিছু দিনের মধ্যে অপরাধ জগতে জড়ালে ২০০৮ সালের ১১ অক্টোবর সুব্রত বাইনকে গ্রেপ্তার করে কলকাতা পুলিশ।

এক পর্যায়ে জামিনে মুক্ত হয়ে তিনি সিঙ্গাপুর, দুবাই, নেপাল ভ্রমণ করে সেসব দেশের অপরাধীদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলেন। এমনকি আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গেও তার যোগাযোগের তথ্য পাওয়া যায়। ওই সময় ভারত সরকার তার নামে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারি করে।

২০০৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর কলকাতা পুলিশের স্পেশাল ফোর্সের কর্মকর্তারা পিছু ধাওয়া করলে সুব্রত বাইন নেপাল সীমান্তের কাকরভিটা শহরে ঢুকে পড়ে ও নেপালী পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়। প্রকাশ্যে অশোভন আচরণের দায়ে তাকে পূর্ব নেপালের ভাদ্রপুর জেলে রাখা হয়। পরে ঝুমকা কারাগারে নেয়া হয়।

২০১২ সালের ৮ নভেম্বর ওই কারাগার থেকে ৭৭ ফুট লম্বা সুড়ঙ্গ দিয়ে অন্যান্য ১০ জন কারাবন্দির সঙ্গে সুব্রত বাইন পালিয়ে যায়। জেল ভেঙ্গে পালানো এসব অপরাধীরা জেলের ভেতর টুপি তৈরির কাজ করতো এবং রাতের অন্ধকারে মাটি কেটে এই সুড়ঙ্গ তৈরি করেছিলো।

বাঁশ কাটার চাকু দিয়ে মাটি কেটে ২০ ইঞ্চি চওড়া ও ২২ ইঞ্চি উচ্চতার এ সুড়ঙ্গটি তৈরি করা হয়েছিলো। সেই সুড়ঙ্গ দিয়েই নেপালের ঝুমকা কারাগারে থেকে পালিয়ে যান সুব্রত। নেপালের কারাগার থেকে পালিয়ে সুব্রত বাইন পুনরায় কলকাতায় ফিরে আসে। তবে খুব বেশি দিন পলাতক থাকতে পারেননি তিনি।

২০১২ সালের ২৭ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ ও পুলিশের স্পেশাল টাস্কফোর্স যৌথ অভিযান চালিয়ে সুব্রতকে কলকাতার বউবাজার এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের সময় তার কাছ একটি নাইন মিলিমিটার পিস্তল উদ্ধার করা হয়। ভারতে অনুপ্রবেশ ও অস্ত্র রাখার অভিযোগে মামলাও হয়।

সুব্রত কলকাতায় গা ঢাকা দিয়ে ফোনের মাধ্যমে বাংলাদেশে নিয়মিত চাঁদাবাজি করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি কলকাতায় নিজেকে ‘ফতে আলী’ হিসেবে পরিচয় দিতেন। জানা গেছে, ভারতে থেকে নেপালে গিয়েও নিজের নাম বদলে তিনি আত্মগোপন করে ছিলেন।

সুব্রত বাইন তিনটি বিয়ে করেছেন। তার চারটি সন্তান আছে। পরিবারের সদস্যরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগও রাখেন। সুব্রতর প্রথম স্ত্রী লুসির দুই সন্তান রিতু ও রিপন ঢাকায় থাকে। দ্বিতীয় স্ত্রী বিউটির সন্তান ছোটন মায়ের সঙ্গে থাকে। কলকাতায় তার তৃতীয় স্ত্রী জমিলার সঙ্গে থাকে একমাত্র মেয়ে।

পরিবারের সদস্যরা স্বীকার করেছেন, ঢাকার মতো গাজীপুরেও সুব্রত বাইনের একটি সন্ত্রাসী বাহিনী ছিলো। তারা বিভিন্ন কারখানা ও মার্কেট থেকে চাঁদা আদায় করতো। তারা প্রয়োজন মতো সুব্রতর মাকেও ব্যবহার করত। একবার চাঁদাবাজির ঘটনায় তাকে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। সুব্রত সেটা জানার পর মাকে বারণ করেন।

ঢাকার সুব্রত বাইনের মামলার সব কিছু দেখভাল করতেন তার মা কুমুলিনি বাইন। তবে এখন তিনি অসুস্থ। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না। সুব্রতর পরিবার মগবাজারে থেকে গাজীপুরের পুবাইল হারবাইদ নয়াপাড়ায় চলে যায়। সেখানে পাঁচ কাঠা জমি কিনে বাড়ি করেন। এখন সেখানেই থাকেন সুব্রতর পরিবার।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button