
জোবাইদা নাসরীন: বাংলাদেশে এখন যা ঘটছে, তাতে কখনও একদল খুশি হচ্ছে, আরেক দল ঘায়েল হচ্ছে, তো অন্য দল মুখ টিপে হাসছে। অনেকটা ঠিক বর্শা নিক্ষেপের মতো। এ ওকে ঘায়েল করার জন্য ‘ঘটনা’ খুঁজছে। কখনও বিএনপি, কখনও জামায়াত আবার কখনও এনসিপি হাসছে, আবার এ দলগুলোই কখনও কখনও রাজনৈতিক চাপে পড়ছে। সারা দিনই রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসাব। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের জনগণ। সেই বিষয়ে কারও কোনও দ্বিমত নেই।
হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, নিপীড়ন এগুলো যখনই হচ্ছে, তখনই সামনে চলে আসছে ঘাতকের এবং নিপীড়কের রাজনৈতিক পরিচয়। তখনই সেই ঘটনার বিচারের চেয়ে বড় হয়ে পড়ছে সেই দলের বিরুদ্ধে মিছিল স্লোগান। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সংঘাত বন্ধ কিংবা এই বিষয় দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের চেয়ে হিসাবের খাতায় সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে এই সংঘাতে কার লাভ কার ক্ষতি হচ্ছে? রাজনৈতিক বল এখন কার কোর্টে সেদিকেই সবার চোখ থাকছে। চলমান সহিংসতাকে সম্বল করে রাজনৈতিক নেতাদের খেলার দর্শক জনগণকে হতে হচ্ছে, কিন্তু হত্যা কিংবা নিপীড়নের শিকার জনগণ নিরাপত্তা কিংবা বিচার কোনোটিই পাচ্ছে না।
সর্বশেষ যদি মিটফোর্ডের সোহাগ হত্যাকে বিবেচনায় আনা হয়, তাহলে কী দেখতে পাই? দিনের বেলায় সবার সামনেই পাথর নিক্ষেপ করে সোহাগকে হত্যার সঙ্গে সঙ্গেই সেই হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। সে সময়ও সরকার এ বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। পরের দিন এই হত্যা নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হলে সরকার এই ঘটনায় জড়িত কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। বিষয়টি এমন হওয়ার কোনও কারণ নেই যে সরকার জানতে পারেনি। কারণ ঘটনার পরপরই ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়। আর তাছাড়া এর আগেই বিভিন্ন সূত্র থেকেই এই ধরনের একটি বীভৎস হত্যাকাণ্ডের কথা সরকারের জানারই কথা।
এর পরপরই হত্যাকারীদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সব জায়গায় প্রতিবাদ, দেশে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেই রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে মিছিল হয়েছে। এখনও তা অব্যাহত আছে। পাঠক লক্ষ করুন- সোহাগ হত্যা নিয়ে যে প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে সেগুলোর বেশির ভাগই হয়েছে বিএনপিকে লক্ষ্য করে। স্লোগানগুলো বিএনপির বিরুদ্ধে। সেখানে হত্যার বিচার এবং জনগণের নিরাপত্তা বিষয়ে কোনও স্লোগান তোলা হয়নি। প্রশ্ন করা হয়নি সরকার এবং সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে। কারণ সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এবং আরও দুই মাস সেই ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। তাহলে খুব স্বভাবতই প্রশ্ন আসে সেনাবাহিনী মাঠে থাকার পরও এ ধরনের ঘটনা কীভাবে ঘটে? জনগণের নিরাপত্তার প্রশ্নে সরকার কী করছেন?
এখন বিএনপি সমাবেশ করছে এবং স্লোগান তুলছে জামায়াতের বিরুদ্ধে। এসব দেখে মনে হচ্ছে বিএনপি-জামায়াতের আপাত বিরোধী অবস্থান সাময়িকভাবে স্বস্তি দিচ্ছে এনসিপিকে। বিএনপি এবং এনসিপি আন্দোলনের পর থেকেই যোজন যোজন দূরত্বে। এনসিপি নেতৃত্ব বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিএনপিকে নিয়ে খোঁচাখুঁচি করেছে। বরং তাদের আদর্শিক সখ্য জামায়াতে ইসলামীর সাথেই। তবে এই মুহূর্তে তাদের নানা সংকটে বিএনপি-জামায়াতের এই পাল্টাপাল্টি অবস্থান কিছুটা হলেও আত্মায় পানি পাওয়ার মতো। কেননা, বিএনপি এবং জামায়াতের ‘বর্ষা নিক্ষেপ’ প্রতিযোগিতায় তাদের ‘ডোনেশন’ ওরফে চাঁদা’র বিষয়টি ফিকে হয়ে যাবে হয়তো। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো রাজনৈতিক এই বিরোধ-স্বস্তির মধ্য দিয়েই হারিয়ে গেছে বা যাবে সোহাগের নির্মম হত্যাকাণ্ড এবং বিচারের প্রশ্ন।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে বিভিন্ন জায়গায় বিএনপি-জামায়াত নিজেরাই এমনভাবে ক্ষমতা চর্চা করা শুরু করেছেন যে মনে হচ্ছে শুধু মানুষই পরিবর্তিত হয়েছে কিন্তু কোনও প্রক্রিয়ার পরিবর্তন হয়নি। নতুন দল হিসেবে এনসিপির বিরুদ্ধেও কম বেশি অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নজন থেকে চাঁদা দাবি, যৌন হয়রানিসহ নানা বিষয়ে তাদের একাধিক নেতা আলোচনায় এসেছেন। এমনকি দুদিন আগেও ৭ লাখ টাকা ‘ডোনেশন’ নেওয়া নিয়েও আলোচনায় রয়েছে এনসিপি।
এক দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে অন্যরা খুশি হয়। আর যদি নিপীড়নের শিকার আওয়ামী লীগের কেউ হয় কিংবা সেই নিপীড়নের ঘটনায় আওয়ামী লীগকে কোনোভাবে যুক্ত করা যায়, তাহলে তো কথাই নেই। বৈধতার রায় সেখানেই হয়ে যায়। এর আগে মুরাদনগরের একজন হিন্দু নারী যখন ধর্ষণের শিকার হলো তখনও কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই সেই ধর্ষকের রাজনৈতিক পরিচয় খুঁজতে মনোযোগী হয়ে গেলো। একজন উপদেষ্টা সেই ধর্ষক ‘আওয়ামী লীগ’র বলে স্ট্যাটাসও দিয়েছিলেন। আমাদের প্রবণতা এমন হয়েছে যে আমরা অপরাধ, অপরাধী খোঁজার আগেই সেটির রায় দিয়ে অপরাধীর রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে এমন উল্লাস তৈরি করি, যেখানে অপরাধ ছোট হয়ে যায় বরং এরপরের আলাপ হয় শুধু রাজনৈতিক দল নিয়েই। আর যিনি অপরাধের শিকার হন, তারা মূলত অদৃশ্য হয়ে যায় সব আলাপ, বিচার থেকে। সোহাগের পরিবার যেমন ভয়ে বাসা থেকে চলে গেছে, তেমনি বাড়ি থেকে আড়ালে চলে গিয়েছিল সেই ধর্ষণের শিকার নারী।
বীভৎস হত্যাকাণ্ড এবং সহিংসতাকে কেন্দ্র করে আমাদের এই রাজনৈতিক উল্লাস আসলে মূলত অপরাধ প্রবণতাকে উসকে দিচ্ছে। কারণ অপরাধীরা জেনে গেছে তাদের বিচার কেউ চায় না, বরং তাদের রাজনৈতিক উপলক্ষ বানায়। তারা বুঝে গেছে তাদের পরিচয় নিয়েই রাজনীতি হবে, অপরকে ঘায়েল করার কৌশল কিংবা অস্ত্রই হবে কিন্তু তাদের কিছু হবে না। অপরাধীরাও মুচকে হেসে আবার শানিত করে নতুন অপরাধ প্রবণতাকে। আর রাজনৈতিক নেতারা খেরো খাতায় লেখে বল এখন কার কোর্টে?
লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।