গণমাধ্যম ও সংস্কৃতিতে নারীর অন্তর্ভুক্তিতে যা সুপারিশ করা হলো
নারীরা ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান

গণমাধ্যমের প্রত্যেক শাখা ও স্তরে ৫০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চায় নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন। গণমাধ্যমে নারীর সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে আইন ও নীতি সংস্কার জরুরি বলে মনে করে তারা। এ লক্ষ্যে ম্যাস মিডিয়া অ্যামপ্লয়িজ অ্যাক্ট-২০২২ পর্যালোচনা করে বৈষম্যমূলক দিকগুলো সংশোধন করা প্রয়োজন বলে সুপারিশ প্রতিবেদনে প্রস্তাব করেছে কমিশন।
এদিকে নারীরা ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখলেও এখনো নানা বৈষম্যের সম্মুখীন হচ্ছেন বলেও সংস্কার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
সম্প্রতি নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান ও নারী পক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরিন পারভীন হকের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে তাদের সুপারিশ মালা পেশ করে।
নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে গঠিত হয়। ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে কমিশনের সদস্যদের ৪৩টি নিয়মিত বৈঠক হয়। নারীর অধিকার, উন্নয়ন সংস্থা, শ্রমিক সংগঠন, পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ৩৯টি পরামর্শ সভা করে কমিশন। পরামর্শ সভা গুলো ঢাকা-চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটি খুলনা শ্রীমঙ্গল রংপুর ময়মনসিংহ হয়।
গণমাধ্যমে নারীর অংশগ্রহণ, চিত্রায়ণ ও প্রকাশ
এ প্রসঙ্গে সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত সুপারিশ প্রতিবেদনে বলা হয়, গণমাধ্যম সমাজের প্রতিচ্ছবি বহন করে। কিন্তু এখানেও নারী পুরুষের মধ্যে বৈষম্য স্পষ্ট। নারীদের হেয় করে উপস্থাপন, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে বৈষম্যকে উৎসাহিত করে। সাংবাদিকতায় নারীদের অংশগ্রহণ এখনো সীমিত, বিশেষত রাজনীতি,অর্থনীতি, অপরাধ ও অনুসন্ধানমূলক সাংবাদিকতায়।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দেশে গণমাধ্যমে নারীর অংশগ্রহণ এখনো তুলনামূলকভাবে কম। কিছু ক্ষেত্রে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ হলেও অনেক জায়গায় তা আরও কম। বিশেষ করে সিনিয়র পদ (সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক, চিফ রিপোর্টার) কিংবা ফিল্ড রিপোর্টিংয়ে নারীদের উপস্থিতি অনেক কম। ফলে সরাসরি ৫০ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা এখনকার অবকাঠামো, দৃষ্টিভঙ্গি ও বাস্তব প্রেক্ষাপটে চ্যালেঞ্জিং। এ লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে হলে নারী সাংবাদিকদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ, নিরাপত্তা, কর্মপরিবেশ উন্নয়ন এবং নেতৃত্ব বিকাশ কর্মসূচি চালু করতে হবে। নতুন নারী কর্মী তৈরি না করে শুধু কোটা নির্ধারণ করলে তা টেকসই হবে না।
যদি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকার বা নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে নীতিমালায় বাধ্যতামূলক নারী অন্তর্ভুক্তির নির্দেশনা থাকে তাহলে এটি বাস্তবায়ন অনেকটাই সহজ হবে। নাহলে কেবল সুপারিশের মাধ্যমে এই মাত্রার পরিবর্তন আনা কঠিন।
গণমাধ্যমের বাইরের সামাজিক মানসিকতাও এখানে বড় ভূমিকা রাখে। রাতে বা ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্বে নারীর অংশগ্রহণ অনেক সময় বাধাগ্রস্ত হয় পারিবারিক বা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। এগুলো বদলাতে সময় লাগবে।
ইদানীং অনেক নারী সাংবাদিক ভালো অবস্থানে আসছেন, নেতৃত্বও দিচ্ছেন। নারী সংবাদকর্মীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। বিশেষ করে টেলিভিশন ও অনলাইন মিডিয়ায় তাদের উপস্থিতি দৃশ্যমান। এই গতি যদি সঠিকভাবে ধরে রাখা যায় এবং নীতিগত সহায়তা দেওয়া হয় তাহলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ৫০ শতাংশ লক্ষ্য বাস্তবসম্মত হতে পারে।
সুপারিশ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সাংবাদিকদের বেতন কাঠামো নির্ধারণের মজুরি বোর্ড গঠন করতে হবে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নারীদের বিরুদ্ধে সাইবার বোলিং ও যৌন হয়রানি রোদে বিশেষ আইন প্রণয়ন করা দরকার।
জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা-২০১৪ অনুসারে, নারী ও অন্যান্য লিঙ্গের সম্মানজনক উপস্থাপনা নিশ্চিত করতে বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ২০০৯ সালের হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী অভিযোগ কমিটি গঠন করা জরুরি। সাংবাদিকতা প্রশিক্ষণের নারীবান্ধব উপস্থাপনার কৌশল, ভাষার যথাযথ ব্যবহার ও মূল্যায়ন পদ্ধতি সংযোজন করা প্রয়োজন।
গণমাধ্যমে নারীর ইতিবাচক উপস্থাপনা বাড়াতে তাদের অর্জন ভূমিকা তুলে ধরতে হবে। সহিংসতার স্বীকার নারীর পরিচয় গোপন রাখা উচিত। অভিবাসী নারী শ্রমিকদের অবদান সম্পর্কে গণমাধ্যমে ইতিবাচক প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে সমাজের সচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার।
বৈষম্যমূলক আচরণ, নারীর নেতিবাচক উপস্থাপন ইত্যাদি বিষয়ের জন্য একটি অভিযোগ ও নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া চালু করা দরকার বলে সুপারিশ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
ক্রীড়া ও সংস্কৃতিতে নারীর অন্তর্ভুক্তি ও বিকাশ
এ প্রসঙ্গে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, নারীরা ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখলেও এখনো নানা বৈষম্যের সম্মুখীন হচ্ছেন বলে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয় নারী ক্রীড়াবিদদের বেতন পুরুষদের তুলনায় অনেক কম, এমনকি পুরস্কারের অর্থে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য বিদ্যমান। ২০২৪ সালে দক্ষিণ এশিয়া চ্যাম্পিয়ন হওয়া সত্য বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল টুর্নামেন্টের আগে তিন মাস বেতনহীন ছিলেন।
এছাড়া জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ থেকে মহিলা ক্রীড়া সংস্থাগুলো পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ পায়না এবং নারী সংস্কৃতি কর্মীদের জন্যও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব রয়েছে যা তাদের পেশাগত বিকাশ কে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
নারীদের ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সমান সুযোগ ও ন্যায্য পারিশ্রমিক নিশ্চিত করতে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ আইন ২০১৮ সংশোধন করা প্রয়োজন। ক্রীড়া পরিষদ ও বিভিন্ন ক্রীড়া সংস্থার নারীদের প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে হবে এবং রাজনৈতিক নিয়োগের পরিবর্তে দক্ষতার ভিত্তিতে সদস্য নিয়োগের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে বলে সুপারিশ করা হয়।
পার্বত্য ও প্রান্তিক অঞ্চলের সম্ভাবনাময় কিশোরীদের ক্রীড়া প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আইন ২০২০ সংশোধন করা জরুরি। নারী ও পুরুষ ক্রীড়াবিদদের বেতন বৈষম্য দূর করতে জাতীয় ক্রীড়া বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা প্রয়োজন।
সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নারীদের নিরাপদ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে বিবেচনায় নিয়ে নতুন অনুচ্ছেদ সংযোজন করে জাতীয় সংস্কৃতি নীতি ২০০৬ সংশোধন করা দরকার। পেশাদার সাংস্কৃতিক কর্মীদের জন্য চুক্তিপত্র বাধ্যতামূলক করা জরুরি যাতে তাদের অধিকার আইনেই সুরক্ষা নিশ্চিত হয়। এছাড়া নারীদের বিনামূল্যে ক্রীড়া সরঞ্জাম ও পোশাক সরবরাহ করতে হবে যাতে তারা খেলাধুলায় আরো উৎসাহিত হন।
শিল্পকলা একাডেমি ও শিশু একাডেমির মাধ্যমে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সাংস্কৃতিক প্রশিক্ষণ ও প্রতিযোগিতার পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করা দরকার। বিদ্যালয় প্রতিবন্ধী মেয়ে শিশুদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় আন্তর্জাতিক ক্রীড়ামণ্ডলে ক্রীড়া ও সংস্কৃতির সব ক্ষেত্রে নারীর উজ্জ্বল অবাধ ও নিরাপদ অংশগ্রহণ অবদান ও স্বীকৃতি নিশ্চিত হতে হবে বলে সংস্কার বিষয়ক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।